শূন্যতা


শূন্যতা

রাত তখন গভীর। শহর নিস্তব্ধ, অন্ধকার আকাশে ঝলমলে পূর্ণিমার চাঁদ। হালকা শীতল বাতাস জানালার পর্দা উড়িয়ে দিচ্ছে। শায়লা খাটের এক পাশে চুপচাপ বসে আছে, জানালার বাইরে তাকিয়ে। চারপাশ নিস্তব্ধ হলেও তার মনে চলছে এক অবিরাম ঝড়। আজকের রাতটা তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের রাতগুলোর একটি।

আজ থেকে এক বছর আগে এই দিনটিতেই তার জীবন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। আজ থেকে এক বছর আগে এই রাতেই সে হারিয়েছিল নিজের আত্মমর্যাদা, নিজের বিশ্বাস, নিজের অস্তিত্ব।

সেই রাতটা সে কখনো ভুলতে পারবে না। অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তার একটি অন্ধকার গলিতে তিনজন মুখোশধারী লোক তার পথ আটকে দাঁড়ায়। সে কিছু বোঝার আগেই এক শক্তিশালী আঘাতে মাটিতে পড়ে যায়। তারপর যা ঘটেছিল, তা কল্পনারও বাইরে। তার আর্তনাদ, প্রতিরোধের চেষ্টা, কেউ শুনল না, কেউ এলো না সাহায্যে। চারপাশে ছিল কেবল অন্ধকার আর পশুত্বের হিংস্র থাবা।

হাসপাতালের বেডে চোখ খুলে প্রথমেই মনে পড়েছিল সেই নির্মম মুহূর্তগুলোর কথা। ডাক্তার বলেছিল, সে বেঁচে গেছে, কিন্তু শায়লার মনে হচ্ছিল, তার ভেতরের মানুষটা মরে গেছে। সমাজের চোখে সে তখন শুধুই করুণার পাত্র। আত্মীয়স্বজনের সহানুভূতি, প্রতিবেশীদের ফিসফাস—সব কিছু যেন তাকে আরো বেশি অসহায় করে তুলছিল।

আজও সে ঠিক একইভাবে জানালার পাশে বসে আছে। বাইরে পূর্ণিমার চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে, কিন্তু সেই আলো তার জীবনে কোনো উষ্ণতা বয়ে আনতে পারছে না। একদিন রায়হান বলেছিল, "যদি আমি কখনো না থাকি, তুমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকো। মনে হবে, আমি তোমার পাশেই আছি।" কিন্তু এখন তার পাশে কেউ নেই, কেবল এক গভীর শূন্যতা।

চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলো আর ধরে রাখতে পারল না শায়লা। ধীরে ধীরে তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা জল। সে মাথা উঁচু করে চাঁদের দিকে তাকাল, কিন্তু এবার সেখানে কোনো আশা নেই, নেই কোনো ভালোবাসার অনুভূতি। আছে কেবল এক শেষ না হওয়া অন্ধকার।

রাত বাড়তে থাকল, আর চাঁদের আলোয় শায়লার মুখটা ধীরে ধীরে ভিজে উঠল নীরব কান্নায়।

Comments